বাংলাদেশ তামাক পাতা উৎপাদনে বিশ্বে ১৪তম। কিন্তু সিগারেটের বাজারের দিক দিয়ে বিশ্বে অষ্টম! ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসায় মুনাফা এবং নিজেদের বাজার ধরে কতোটা বেপরোয়া। সিগারেটের বাজার ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, রাজস্ব ফাঁকি ও নিজেদের প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি নিষিদ্ধ থাকলেও এর সবগুলোই তারা করছে নানা কূটকৌশলে।
তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। এর কারণ খুচরা শলাকায় সিগারেট বিক্রি এবং নির্ধারিত মূলের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হওয়ায় সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। পাশপাশি তরুণদের মধ্যেও সিগারেট গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু সিগারেট কোম্পানি নানা কূটকৌশল ও অজুহাতে এর কোনোটাই বাস্তবায়ন চায় না। তাদের এ না চাওয়ার পিছনে যুক্তি কী? আসলে তামাক কোম্পানির ভাষ্য, সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ হলে সরকারের নাকি রাজস্ব কমে যাবে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রির সঙ্গে নাকি তামাক কোম্পানি কোনোভাবেই যুক্ত নয়! কিন্তু বাস্তবতা কি সেটা বলে?
চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত “তামাকজাত দ্রব্যের (সিগারেট ও বিড়ি) খুচরা ও পাইকারি বিক্রয়মূল্যে জাতীয় বাজেটে মূল্য ও কর পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে একটি সমীক্ষা” শীর্ষক একটি গবেষণায় আমরা দেখেছি দেশে সকল পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্যে বিক্রি হলেও সিগারেট ও বিড়ি হয় না। বরং সিগারেট কোম্পানিগুলোই খুচরা মূল্যে বিক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। আর বিক্রেতারা তার চেয়ে বেশি মুল্যে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। অতিরিক্ত বিক্রয় মূল্যের ওপর কর আদায় সম্ভব হলে চলতি অর্থবছরেই সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো বলেও এ গবেষণায় উঠে এসেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, তামাক কোম্পানিগুলো খুচরা মূল্যে সিগারেট বিক্রি বন্ধ হোক সেটা কেনো চায় না? আসলে এর পিছনেও রাজস্ব ফাঁকির জন্য তাদের রয়েছে আরেক কূটকৌশল। চলতি অর্থবছরের ১ জুনের এসআরও অনুযায়ী অতীতের ন্যায় সিগারেটের চারটি স্তরে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর মধ্যে অতি উচ্চস্তরের ১০ শলাকা সিগারেট প্যাকেটের খুচরা মূল্য ১৪২ টাকা, উচ্চস্তর ১১১ টাকা, মধ্যমস্তর ৬৫ টাকা ও নিম্নস্তর ৪০ টাকা। সে অনুযায়ী অতি উচ্চস্তরের প্রতি শলাকার মূল্য ১৪ টাকা ২০ পয়সা, উচ্চস্তরের প্রতি শলাকা ১১ টাকা ১০ পয়সা, মধ্যমস্তর প্রতি শলাকা ৬ টাকা ৫০ পয়সা ও নিম্নস্তরের প্রতি শলাকা ৪ টাকা।
সিগারেটের এমন অদ্ভূত মূল্য নির্ধারণ বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে। বিষয়টি অদ্ভূত এ কারণেই বলা, মুদ্রাস্ফীতির এ বাজারে ১০ বা ২০ পয়সার কোনো প্রচলন নেই। কিন্তু কেনো এভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়? কারণ ১০ বা ২০ পয়সা বাড়তি উল্লেখ করলে সেখানে ১ টাকা বাড়তি নেয়া যায়! কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষেত্র বিশেষে কেবল ১ টাকা নয়, দেড় থেকে ২ টাকাও বেশি নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে প্যাকেট প্রতি নেয়া হয় ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি।
সম্প্রতি কয়েকটি গণমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললে একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সিগারেটের প্যাকেটে খুচরা মূল্য লেখা থাকে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা থাকে না। ফলে সিগারেটের প্যাকেটে যে খুচরা মূল্য থাকে সেটা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের জন্য! ফলে স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে তাহলে ভোক্তাদের কাছে কতো টাকায় বিক্রি হবে? সেটা নির্ধারণ করে কে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ এর ধারা ৫৮ অনুযায়ী প্রতিবছর সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। আইনের ৫৮ এর ২-তে বলা হয়েছে, “উক্ত বিশেষ পরিকল্প দ্বারা বোর্ড উক্ত পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিবে এবং উক্ত মূল্য মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য হিসাবে গণ্য হইবে”। ফলে এনবিআর যখন জারি করা এসআরও ৫৮ ধারা অনুযায়ী প্রকাশ করে তখন সেখানে সর্বোচ্চ শব্দ ব্যবহার করুক বা না করুক সেটা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যই থাকে। ফলে তামাক কোম্পানির অহেতুক যুক্তি ও কূটকৌশল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর গবেষণায় দেখা গেছে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার পিছনে তামাক কোম্পানিই সরাসরি জড়িত! কারণ অন্যান্য পণ্য বিক্রি করার সময় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী ও মধ্যসত্বভোগীর মুনাফা বাদ দিয়ে সেটা বাজারে ছাড়ে। ফলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই সেই পণ্যটি ভোক্তারা কিনতে পারে। কিন্তু সিগারেটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই তামাক কোম্পানিগুলো বাজারে ছাড়ে এবং পাইকারী বিক্রেতাদেরই খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে খুচরা বিক্রেতারা আরও লাভে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করতে বাধ্য করছে তামাক কোম্পানি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হলে মানুষ কেনে কোনো? আসলে তারা মানুষের নিকোটিনে আসক্তি নিয়ে ব্যবসা করে। তারা জানে, মূল্য বেশি নিলেও নিকোটিনে আসক্ত এসব মানুষ ঠিকই সিগারেট কিনবে। কারণ তাদের এটা ছাড়া আর উপায়ও নেই।!তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটে সাত হাজারের বেশি কেমিক্যাল মেশানো হয়। ভয়াবহ এসব কেমিক্যালে আসক্ত হয়ে মানুষ হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে।
তবে আশার কথা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর গবেষণাটি নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ ও তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোর অভিযোগের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন কবে এবং কতোটুকু হবে সেটার জন্যই অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ, বহুস্তরভিত্তিক তামাক কর কাঠামো, তামাকে সুনির্দিষ্ট করারোপ না করাসহ সিগারেটে রাজস্ব ফাঁকির বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথযথ পদক্ষেপের অভাব রয়েছে বলেই হয়। সেটা নাহলে বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার পরও তারা পদক্ষেপ নেয়নি কেনো? তারপরও আমরা আশাবাদী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা যথা সময়েই পূরণ করা সম্ভব হবে। কারণে সরকারের সম্প্রতিকালের নানা উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
লেখক : ইব্রাহীম খলিল, প্রজেক্ট অফিসার, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)