তামাক নিয়ন্ত্রণে গত কয়েক বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি চলমান উদ্যোগে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে বেশ খানিকটা। সিগারেট প্যাকেটের ৫০ শতাংশ জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক ছবির ব্যবহারসহ আইন-বিধি প্রণয়ন ও সংশোধন হয়েছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন বেশ কিছু উদ্যোগ। কোম্পানির হস্তক্ষেপসহ নানামুখী প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার পরও গেল ১০ বছরে সার্বিকভাবে তামাক ব্যবহারকারী কমেছে ৮ শতাংশ।১
গ্যাটসের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ সালে ১৫ বছরের উর্ধ্বে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সবধরনের তামাক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। যেটা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এ অর্জন ভাল, কিন্তু এখনও তা সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনতে আরও অনেকটা পথ বাকী রয়েছে। সহজ কর কাঠামো, ই-সিগারেট-হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্ট ব্যবহার নিষিদ্ধসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর বাস্তবায়নে ভারতসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক হুমকি হওয়ায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পুরো ভারতে সবধরনের ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার।২ বাংলাদেশে দ্রুত গতিতে বাড়ছে ভ্যাপসহ ইলেকট্রিক বা ই-সিগারেটের ব্যবহার ও ব্যবসা। তরুণরা দলে দলে আকৃষ্ট হচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলোর নিত্য নতুন মোড়কে ই-সিগারেট দেখে। কিন্তু এখনও ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
আর এসব কারণে জনসংখ্যার বিবেচনায়, বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশ, চীন ও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের সেবনকারীর সংখ্যা এখনও অনেক অনেক বেশি। গ্যাটসের ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৫ বছরের উর্ধ্ব বয়সী ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করে। যা মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ ভাগ! এ কারণে বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ তামাক ব্যবহারকারী দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।৩
অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ১৩৭ কোটি মানুষের দেশ চীন, সেখানে তামাক সেবনকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ।৪ আর প্রতিবেশি ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের দেশে এই হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ।৫ ২০ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানে এই হার ১৯ শতাংশ।৬ অর্থাৎ আমাদের জনসংখ্যা ও তামাক ব্যবহারকারীর অনুপাতে চীন-ভারতের সাথে তুলনা করা হলে ভয়াবহ চিত্র আরও স্পষ্ট হবে। বাংলাদেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ তামাক সেবনকারীর অনুপাত যদি চীনের ১৩৭ কোটির সাথে তুলনা করলে সেদেশে তামাক ব্যবহারকারী দাঁড়াতো প্রায় ৫০ কোটিতে। অথচ চীনে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারী ৩০ কোটি। একইভাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনুপাত হিসাব করলে দেশটিতে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৪৬ কোটিতে। ভারতে তামাক সেবনাকারী ২৭ কোটি, যা তাদের জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানই বলছে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণে এখনও কতটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
অথচ পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ (ব্যবহার ৫ শতাংশের নিচে নামলেই ধরা হয় তামাকমুক্ত দেশ) গড়তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন ২০১৬ সালে।৭ বিশ্বের অন্য কোনো সরকার প্রধান এমন অঙ্গীকার করেননি। শুধু ঘোষণা নয়, তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নের করণীয় তুলে ধরেছেন, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য আমাদের সকলের জন্য। ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,
বিদ্যামান সিগারেটের চার স্তর বিশিষ্ট জটিল কর কাঠামো যে, তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে এবং তামাকখাতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে বড় অন্তরায়-তা অনুধাবন করেই শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতিপ্রণয়নের তাগিদও দিয়েছেন সরকার প্রধান। কিন্তু ৭ বছরেরও সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংস্থা-মন্ত্রণালয়গুলোর আশাব্যাঞ্জক কোনো অগ্রগতি নেই। তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে হাতে আছে আর মাত্র ১৮ বছর, তাই এখনই শক্তিশালী কর কাঠামো ও আইনী সংস্কার করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়ন কঠোরভাবে শুরু করতে জোরোশোরে উদ্যোগ নেয়ার বিকল্প নেই। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ কেবল জনসংখ্যার বিবেচনায় তামাক সেবনে অষ্টম শীর্ষস্থানীয় নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ সিগারেট উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে।৮ প্রতিবছরই হু হু করে বাড়ছে সিগারেটের উৎপাদন। সেই সাথে বাড়ছে বিড়ি, জর্দা-গুলের উৎপাদন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৭ হাজার ১৮৭ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়েছে।৯ অর্থাৎ গড়ে দৈনিক ১৯ কোটি ৭৫ লাখ সিগারেট বিক্রি হয় বাংলাদেশে। চার স্তর বিশিষ্ট সিগারেটের মধ্যে প্রিমিয়াম স্তরে ৫৯৩ কোটি শলাকা, উচ্চ স্তরে ৫৬৭ কোটি শলাকা এবং মধ্যম স্তরে ৬০৩ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়েছিল ঐ অর্থবছরে। আর নিম্ন স্তরের সিগারেট বিক্রির পরিমান ছিল ৫ হাজার ৪২৪ কোটি শলাকা। যা মোট সিগারেটের ৭৫ ভাগই নিম্ন স্তরের। কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিক্রিত নিম্ন স্তরে কম রাজস্ব পায় এনবিআর। কারণ নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম খুবই কম। বিশ্বের কোথাও এত কম দামে সিগারেট পাওয়া যায় না। আবার এই কম দামের সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্কসহ করভার বেশ কম। ফলে খুবই সস্তা হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষের মধ্যে সিগারেট সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। বিপরীতের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার।
বর্তমানে নিম্ন স্তরের ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৩৯ টাকা প্লাস। সরকারি হিসাবে ১০ শলাকার হিসাব করা হলেও সিগারেট কোম্পানীগুলো বিক্রি করে ২০ শলাকার প্যাকেট। নিম্ন স্তরের ২০ শলাকার প্যাকেটের দাম ৭৮ টাকা। এই দামের মধ্যে অন্তুভূক্ত রয়েছে সম্পূরক শুল্ক বা এসডি আছে ৫৭ শতাংশ, সাথে অন্যান্য স্তরের মতোই মূল্য সংযোজন কর-মূসক ১৫ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ১ শতাংশ; মোট করভার (৫৭%+১৫%+১%)=৭৩ শতাংশ। অথচ ওপরের তিন স্তরের সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশসহ মোট করভার ৮১ শতাংশ।১০ এ কারণে সর্বাধিক বিক্রিত নিম্ন স্তরের সিগারেটে কোম্পানির মুনাফা করার সুযোগ ৮ শতাংশ থাকছে। টাকার অংকে ২০ শলাকার এক প্যাকেটে নিম্ন স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭৮ টাকার মধ্যে ৭৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৫৭ টাকা রাজস্ব পায় এনবিআর। বাকী ২১ টাকা থাকছে কোম্পানির খরচসহ মুনাফার অংশ।
উপরের তিন স্তরের মতো নিম্ন স্তরেও সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ করে মোট করভার ৮১ শতাংশ করার দাবি দীর্ঘ দিন ধরে করছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনকারীরা। যদি নিম্ন স্তরে করভার ৮১ শতাংশ হলে তাহলে ৭৮ টাকার মধ্যে সরকার রাজস্ব পেত ৬৩ টাকা। আগে যা পেত ৫৭ টাকা। শুধু সম্পূরক শুল্ক বাড়ালেই নিম্ন স্তরে প্রতি প্যাকেটে বাড়তি রাজস্ব পেত ৬ টাকা, অথ্যাৎ বছরে ২৭১ কোটি ২৯ লাখ প্যাকেটে নতুন করে রাজস্ব আসতো ১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। আগেই বলেছি বাংলাদেশের সিগারেটের মোট বিক্রির ৭৫ শতাংশই নিম্ন স্তরের। সংখ্যায় ৫ হাজার ৪২৪ কোটি শলাকা। বিপরীতে প্রতি প্যাকেটে কোম্পানির অংশ ২১ টাকা থেকে কমে হতো ১৫ টাকা। এতে সরকারের রাজস্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেত, একইসাথে কোনো ধরনের খরচ ছাড়াই কোম্পানির বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ থাকতো না।
আর সিগারেটের চার স্তরের মধ্যে প্রিমিয়াম ও উচ্চ এ দুই স্তর মিলে উচ্চ এবং মধ্যম ও নিম্ম স্তর দুটিকে নিম্ম স্তর নামে দুটি স্তর করা জরুরি। দুই স্তরের ওপরে অভিন্ন করভারের সাথে প্যাকেট প্রতি সুনির্দিষ্ট কর বা স্পেসিফিক ট্যাক্স আরোপ করা সময়ের দাবি। বর্তমানে মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের ওপর স্পেসিফিক ট্যাক্স রয়েছে। ঠিক একইভাবে এনবিআর যদি প্রতি প্যাকেটে বিদ্যমান দাম ও করের সাথে বাড়তি প্রতি ৫ টাকা করে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করে তাহলে ২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পাবে সরকার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এতে সব সিগারেটের প্যাকেট প্রতি দাম ৫ টাকা করে বাড়বে, যার পুরোটায় সরকারের কোষাগারের যাবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এভাবে প্যাকেট প্রতি সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে জনস্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি রাজস্ব বাড়িয়েছে বহুগুণে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে বাড়ানোর অত্যন্ত যৌক্তিক ও কার্যকর পদ্ধতি ‘স্পেসিফিক ট্যাক্স’ সম্পর্কে এনবিআরের কর্মকর্তা ও সরকারি নীতি নির্ধারকদের রাজস্ব হারানোর জুজুর ভয় দেখিয়ে বিভ্রান্ত করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। দালিলিক প্রমাণ ও উদাহরণের ভিত্তিতে দার্থ্যহীন ভাষায় বলতে পারি, স্পেসিফিক ট্যাক্স আরোপ এনবিআরের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে। বিপরীতে কমবে তামাক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ।
একইভাবে বিড়ি, জর্দা ও গুলের ওপর সুনির্দিষ্ট কর বসিয়ে উৎপাদন নজরাদারি করলে এখান থেকে বাড়তি হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় আসতে পারে। বর্তমানে জর্দার ওপরে ন্যূনতম ১০ গ্রাম ওজন ধরে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ৫৫ শতাংশ সম্পুরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূসক এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল আছে। জর্দার মতো ৭১ শতাংশ করভার আছে ২০ টাকা মূল্যের ১০ গ্রামের গুলের ওপর। কিন্তু বাজারে জর্দা-গুলের বিক্রি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা হলেও এ খাতে রাজস্ব আসে নামমাত্র। বছরে অর্ধ শত কোটি টাকাও রাজস্ব পায় না সরকার। এমনকি বাজারে বিক্রিত চার শতাধিক ব্র্যান্ডের জর্দার মধ্যে বেশিরভাগই কৌটা ও প্যাকেটের গায়ে দাম উল্লেখ করে না জর্দা ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি বিক্রিত হাজী কাউছ মিয়ার হাকিমপুরী জর্দার কৌটা ও প্যাকেটের গায়ে দাম উ্ল্লেখ করেনা। করযুক্ত পণ্যের গায়ে দাম উল্লেখ না করাটা আইনের লংঘন। এতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ অবারিত হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এমন আইনের লংঘনের পরও বছরের পর বছর সবোর্চ্চ করদাতার পুরস্কার পেয়ে আসছে হাকিমপুরী জর্দা কোম্পানির মালিক হাজী কাউছ মিয়া। এমনকি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সেরা করদাতা হিসাবে জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়াকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যে নাজরাদারি বাড়ালে এখন থেকে শত শত কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পাবে সরকার।
এজন্য করণীয় হিসাবে, সবার আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বন্ধ থাকা টোব্যাকো সেল বা তামাক সেলের পুনরায় চালু করা জরুরি। কারণ তামাক কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি বন্ধে তামাক সেলের সক্রিয়করণ হতে পারে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সিগারেটসহ সকল তামাকজাত দ্রব্যের সবোর্চ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপি নির্ধারণ করে দিয়েছে এনবিআর। এমআরপি বা প্যাকেটের গায়ের দামে কিনবে ভোক্তারা। কিন্তু বছরের পর পর এমআরপি আইন ভঙ্গ করে সিগারেট কোম্পানিগুলো তাদের এজেন্টের মাধ্যমে খুচরা দোকানীদের কাছেই এমআরপি রেটে সিগারেট বিক্রি করছে। ফলে খুচরা বিক্রেতারা ক্রেতা/ভোক্তাদের কাছে প্যাকেটের গায়ে উ্ল্লেখ করা দামের চেয়ে বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি করছে। যেমন ২৭০ টাকার ২০ শলাকার এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কোথাও ২৯০ টাকায়, কোথায় ৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। আর খুচরা শলাকা বিক্রির ক্ষেত্রে গড়ে দাম সাড়ে ১৩ টাকা হলেও তা বিক্রি করা হয় ১৫ টাকায়। গড়ে সব স্তরের সিগারেটের প্রতি শলাকায় ১ টাকা করে বাড়তি নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানীগুলো।
আগেই উল্লেখ করেছি, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ কোটি সিগারেট বিক্রি হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে বাড়তি আদায় করছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। বছরে যা ৭ হাজার কোটি টাকা।১১ এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে পেতো সরকার। একদিকে জনগণের কাছ থেকে বাড়তি নিচ্ছে নিয়ম ভঙ্গ করে অন্যদিকে এই টাকা থেকে একটি টাকাও রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। বছরের পর এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকা বাড়তি বিক্রির পাশাপাশি জাতীয় বাজেটের আগে কৃত্রিমভাবে সিগারেটের সরবরাহ কমিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। বাজেটে তামাকের দাম বাড়বে এমন অজুহাতে একমাস আগেই তারা প্রতি শলাকায় আরও এক টাকা করে বাড়তি দামে জনগণকে কিনতে বাধ্য করে। এবছরও তার ব্যতিক্রম করেনি সিগারেট কোম্পানিগুলো। দেশের সিগারেটের সিংহভাগ বাজার বিএটিবি’র দখলে। আর সিগারেট অন্য কোনো কোম্পানির বানানোর সুযোগ নেই। আর ফি বছর বাজেটের আগে এপ্রিল-মে মাসে সিগারেটের উৎপাদন কমার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। ফলে সিগারেট কোম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশে মজুদদারি আইন অনুযায়ী পণ্য মজুদ করে সংকট সৃষ্টি করার সবোর্চ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন জেলের বিধান রয়েছে। এনবিআরের তামাক সেল থাকলে তারা এ এমআরপি আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারতো। এতে রাজস্ব ফাঁকি কমতো অনেকাংশে। সরকারের জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও দায় এড়াতে পারে না। কারণ তারা সব ধরণের বাজার তদারকি ও ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা।বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণহীন ই-সিগারেট বন্ধ করতে হবে প্রতিবেশী ভারতের মতো। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হতে হলে দেশের আপামর জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তাই হৃদরোগ,ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে তামাকের ব্যবহার কমাতে হবে কার্যকরভাবে। ২০৪০ সালে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, ই-সিগারেটসহ সবধরের তামাক পণ্য ।অকাল মৃত্যু হাত থেকের লক্ষাধিক মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি পরিবেশ-কৃষি জমিসহ দেশে তামাকজনিত ক্ষতি বছরে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে তামাকজনিত দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি বন্ধ করতে পারলেই প্রতিবছর দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়বে। ২০৪১ সালের উন্নত দেশে পরিণত হওয়া অনেকটাই সহজ হবে বাংলাদেশের। তামাককে রুখতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে, এখন এনবিআরসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তা-নীতি নির্ধারকেদের উদ্যোগী ভূমিকা একান্ত কাম্য সবুজ-শ্যামল সোনার বাংলাদেশের।
লেখক: সুশান্ত সিনহা, বিশেষ প্রতিনিধি, একাত্তর টেলিভিশন এবং জনস্বাস্থ্য ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষক
sinhasmp@yahoo.com
তথ্যসূত্র
১.https://ntcc.gov.bd/ntcc/uploads/editor/files/GATS%20Report%20Final-2017_20%20MB.PDF
৩. https://worldpopulationreview.com/country-rankings/smoking-rates-by-country
৪. https://www.tobaccofreekids.org/assets/global/pdfs/en/China_tob_burden_en.pdf
৫. https://www.tobaccofreekids.org/problem/toll-global/asia/india
৬. https://www.tobaccofreekids.org/problem/toll-global/asia/pakistan
৭. http://bnttp.net/resource/868-2/
৮. https://indonesiadesignstudio.blog/2019/11/27/the-male-strive-to-become-a-smoking-warrior/
৯. ২৪ মে ২০২২ তারিখে, ‘কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণে তামাক কোম্পানি থেকে শেয়ার প্রত্যাহারে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপক সুশান্ত সিনহার প্রেজেন্টশন: https://fb.watch/dlvhQ1r5wm/
১০. http://bnttp.net/resource/tobacco-tax-myth-and-reality-by-sushanta-sinha/
১১. https://www.youtube.com/watch?v=BztQKmbLCXU