গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশের সময় বাড়ানো হয়েছে সবধরনের সিগারেটের দাম। সিগারেটের চার স্তরের মধ্যে প্রিয়িয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকায় ৭ টাকা, উচ্চ স্তরে ৯ টাকা, মধ্যম স্তরে ২ টাকা এবং সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া নিম্মস্তরে বাড়ানো হয়েছে ১ টাকা। মজুদদারি ও কারসাজি ঠেকাতে অর্থবিলের নিয়ম অনুযায়ী বাজেটে কোনো পণ্যের দাম বা শুল্ক কমানো বা বাড়ানো হলে তা ঐদিন অথ্যাৎ বাজেটের পেশের দিন থেকেই কার্যকর হয়। সেই অনুযায়ী, সবধরনের সিগারেটের নতুন দাম কার্যকর হয় ৯ জুন ২০২২ সাল থেকে। কিন্তু দেশের বাজারে এখনও বেনসন গোল্ডলীফ, লাকি স্ট্রাইক,স্টার,রয়েলস,ডার্বি,পাইলট,হলিউডসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে।
কিন্তু এসব ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেটে এখনও মুদ্রিত রয়েছে বাজেটের আগের দাম।যেমন প্রিমিয়াম স্তরের বেনসন সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেটে গায়ের দাম উল্লেখ রয়েছে ২৭০ টাকা। অথচ বিএটিবি বিক্রি করছে নতুন দাম ২৮৪ টাকায়, অথ্যাৎ নতুন দামে। ২৭০ টাকা মুদ্রিত প্যাকেটের ২৮৪ টাকায় বিক্রি করায় বর্ধিত ১৪ টাকার মধ্যে ১১ টাকা ৩৪ পয়সা সরকার রাজস্ব পেত।কিন্তু পুরান স্ট্যাম্পযুক্ত হওয়ায় বাড়তি রাজস্ব পায় নি এনবিআর। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া পুরো টাকায় পেয়েছে ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ-বিএটিবি।তামাক নিয়্ন্ত্রণ গবেষক ও সাংবাদিক সুশান্ত সিনহার গবেষণা অনুযায়ী, বাজেট পরবর্তী একমাসে প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেট বিক্রি করে ২৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিটি। একইভাবে গোল্ডলীফসহ উচ্চ স্তরে বর্ধিত ১৮ টাকার মধ্যে ১৪ টাকা ৫৮ পয়সা হিসাবে ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির চিত্র উঠে এসেছে তার গবেষণায়। মধ্যম স্তরে বর্ধিত ৪ টাকার মধ্যে ৩ টাকা ২৪ পয়সা হিসাবে জুলাই মাসে ৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং নিম্নস্তরে প্রায় ২৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির চিত্র উঠে গবেষণায়। সবমিলিয়ে বাজেট পরবর্তী একমাসে পুরান গায়ের রেটের সিগারেট বর্ধিত দামে বিক্রি করে ৯৫ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে জানান সুশান্ত সিনহা।
রাজস্ব ফাঁকি দিতে এনবিআর তথা সরকারের আইনের গুরুত্বর লংঘন করেছে বিএটিবি। বাজেটের পেশের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এসআরও অনুযায়ী পুরানো গায়ের রেটের সিগারেট নতুন দামে বিক্রি করার সুযোগ নেই। এসআরওতে বলা হয়েছে, উৎপাদিত বা আমদানিকৃত তামাকযুক্ত সিগারেটের মূল্য নির্ধারণসহ উহার প্যাকেটে স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ব্যবহার পদ্ধতি বিধিমালা সংক্রান্ত এস আর ও তে বলা হয়েছে “(খ)০৯ জুন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ বা তার পরে সরবরাহ করা সকল সিগারেটের ক্ষেত্রেই(পূর্বে উৎপাদিত ও মজুদসহ) নুতন মূল্যস্তর অনুযায়ী শুল্ক-কর আদায় নিশ্চিত করিতে হইবে। ০৯ জুন,২০২২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের পূর্বের খুচরা মূল্য মুদ্রিত সিগারেটের প্যাকেটে সীল দ্বারা নুতন খুচরা মুল্য মুদ্রণ করিতে হইবে। ব্যবহারের জটিলতা পরিহার করিবার লক্ষ্যে সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যত শীঘ্র সম্ভব নুতন খুচরা মূল্যের প্যাকেট মুদ্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে;”
কিন্তু এখনও বাজারের বিএটিবির সকল ধরনের সিগারেটের প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে পুরানো গায়ের রেটে যেখানে এনবিআরের নির্দেশিত কোনো নতুন দামের স্টিকার বা সীল দেয়া নেই। রাজস্ব ফাঁকির দেয়ার পাশাপাশি আইনের স্পস্ট আইনের লংঘন করেছে দেশের বাজারের সিংহভাগ সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ।
তামাক নিয়ন্ত্রক গবেষক সুশান্ত সিনহা বলেন,এনবিআর প্রতিবার সর্বোচ্চ করদাতা হিসাবে বিএটিবিকে পুরস্কৃত করে। অথচ তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ৯৬ শতাংশই দেয় জনগণ। ২০২০ সালে বিএটিবি ২৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে রাজস্ব দেয়ার কথা বলেছে। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক,ভ্যাট, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ও কাস্টমস ডিউটি থেকে এসেছে ২৩ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। যা সিগারেট কেনার সময় ভোক্তা তথা জনগণ দিয়ে থাকে।অথ্যাৎ ৯৬ শতাংশ টাকাই জনগণ দেয় কিন্তু সর্বোচ্চ করদাতার ক্রেডিট নেয় বিএটিবি। সুশান্ত সিনহার বলেন,বিএটিবি মাত্র ১ হাজার ৬ কোটি টাকা আয়কর দিয়েছে যা তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের মাত্র ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। বিদ্যামান জটিল কর কাঠামোর কারণে ২০২০ সালে বহুজাতিক কোম্পানীটি ১ হাজার ৮৯ কোটি টাকা নীট মুনাফা করেছে। যা আগের বছরের যে ১৮ শতাংশ বেশি। সিগারেট ছাড়া বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায় কর পরবর্তী এত মুনাফা করার সুযোগ নেই বলেও প্রবন্ধে তুলে ধরেন এই তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক।